ক্ষমতাবান, লুটেরা শাসকদের স্বার্থপরতার আগুন নেভাতে একজন নিরীহ শিল্পীকেও যে কী পরিমাণ মূল্য দিতে হয়েছে, ঈশা আফেন্দি তার বড় প্রমাণ! মোঘল সম্রাট শাহজাহান ঠিক করলেন তার স্ত্রী মমতাজের স্মরণে তাজমহল বানাবেন। পারস্য থেকে একজন চিত্রশিল্পীকে নিয়ে আসা হলো তাজের ডিজাইন করার জন্য। তার নাম – ঈশা আফেন্দি। তিনি ছিলেন তাজমহলের তিনজন স্থপতির একজন।
তাজের অন্য দুই স্থপতি, উস্তাদ আহমেদ লাহোরি এবং মীর আবদুল করিম, প্রধানত তাজমহলের কাঠামো নিয়ে কাজ করেছেন। কিন্ত তাজমহলের মূল সৌন্দর্য এবং আকর্ষণের দায়িত্বে ছিলো আফেন্দির দল। তাজের ভেতর এবং বাইরের নিরেট/জালের মতো দেয়ালে বিভিন্ন রঙ, মূল্যবান রঙ্গিন পাথর দিয়ে অসংখ্য সূক্ষ্ম জ্যামিতিক ও ফুলের নকশা করা, মার্বেল পাথরে খোদাই, এবং টাইলস এ ছবি আঁকার কাজে নিয়োজিত ছিলেন তারা। তাজমহলে যেসব ফারসি কবিতার লাইন বা কোরআনের আয়াত ক্যালিগ্রাফি করা আছে, আফেন্দি নিজ হাতে সেসব করেছেন।
সম্রাট শাহজাহানের ভয় ছিলো – আফেন্দিকে ইউরোপিয়ানরা ভাগিয়ে নিয়ে আরও গোটাকয়েক তাজমহল বানিয়ে নেবে। সম্রাটের সেই ‘অবসেশন’ এর মূল্য আফেন্দিকে দিতে হয়েছে সারাজীবন আগ্রায় বন্দী থেকে। কৃতজ্ঞতা জানানো বা বিশেষ স্বীকৃতি তো দূরের কথা, ঈশাকে আর কখনও দেশেই ফিরতে দেয়া হয়নি!
সম্রাট পুত্র আওরঙ্গজেব অবশ্য তাজের কপি (বিবি কা মাকবারা) বানিয়েছেন আওরাঙ্গবাদ শহরে। যদিও আফেন্দির হাত ছাড়া তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি। ‘নকল তাজমহল’ নাম নিয়েই সেটাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
ধারণা করা হয়, তাজের মূল আর্কিটেক্ট এবং ডিজাইনার আসলে আফেন্দিই। কিন্ত অন্য স্থপতিদের হাইলাইট করে তাজমহলের ইতিহাস থেকে খুব কৌশলে আফেন্দির নাম মুছে দেয়ার চেষ্টা করা হয়, যেনো কেউ তার নামও জানতে না পারে। ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩, অর্থ্যাৎ তাজমহলের কাজ শুরু থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত আফেন্দির ইতিহাস জানা যায়। কিন্ত এরপরেই তার নাম বাতাসে মিলিয়ে যায়!
তিনি যে শুধু বন্দী ছিলেন, তা-ই না। তাকে আর কোনো ডিজাইনে হাত লাগানোর অনুমতিও দেয়া হয়নি- যদি তাজের চেয়েও ভালো কিছু এসে যায়, সে ভয়ে। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে একজন শিল্পীর জন্য?
কয়েক দশক আগে তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা হচ্ছিলো। তখন তাজের সবথেকে উঁচু মিনারের সাদা মার্বেলে, ফার্সি ভাষায় খুব ছোট্ট করে খোদাই করা দুটো শব্দ পাওয়া গিয়েছিলো। দুটো শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়েছিলো মিথ্যে ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া এক মহান শিল্পীর বঞ্চনা আর হতাশা। দুটো শব্দ, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় – ‘অভাগা আফেন্দি’।
লিখেছেন – অদিতি অন্তরা
0 $type={blogger}:
Post a Comment
Thank's for your comment.